সংবাদচর্চা ডেস্ক ঃ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনীতে একজন নারী সৈনিকের জীবন এতটাই কঠিন যে খুব তাড়াতাড়ি তাদের বেশির ভাগের মাসিক ঋতুস্রাব পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
বাহিনীর এক সাবেক নারী সেনা আরও জানাচ্ছেন তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই ধর্ষণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক এক ঘটনা!
প্রায় দশ বছর ধরে লি সো ইয়নকে শুতে হয়েছিল একটা বাঙ্ক বেডের নিচের তলায়। ঘরটা তাকে শেয়ার করতে হত আরও জনা পঁচিশেক মহিলার সঙ্গে।
তাদের প্রত্যেককে নিজস্ব ফৌজি উর্দি রাখার জন্য ছোট একটা ড্রয়ার দেওয়া হত। ড্রয়ারের ওপরে রাখতে হত ফ্রেমে বাঁধানো দুটো করে ফোটোগ্রাফ।
তার একটা ছিল উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল-সুংয়ের। দ্বিতীয়টা ছিল তার উত্তরসূরী, এখন প্রয়াত কিম জং-ইলের।
এক দশকেরও বেশি হল তিনি উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে এসেছেন, কিন্তু সেই কংক্রিট ব্যারাকের প্রতিটা গন্ধ, প্রতিটা স্মৃতি তার এখনও টাটকা।
“আমরা খুব ঘামতাম। যে গদির ওপর আমরা শুতাম, সেটা ছিল ধানের তূষের তৈরি। ফলে আমাদের গায়ের সব গন্ধ সেই গদিতে আটকে থাকত। তুলোর গদি নয় তো, তাই ঘামের গন্ধ ও অন্য সব গন্ধ চিপকে থাকত সেখানে – একবারেই ভাল লাগত না।”
এই অবস্থার একটা বড় কারণ ছিল সেখানে স্নান করা বা কাপড়চোপড় পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে।
“একজন নারী হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আমরা ঠিকঠাক স্নানই করতে পারতাম না”, বলছিলেন লি সো ইয়ন।
“গরম জল তো পেতাম না। পাহাড়ের একটা ধর্নার সঙ্গেই হোসপাউপ জুড়ে দেওয়া হত, সেই হোস দিয়েই আমাদের স্নানের জল আসত। তবে তার সঙ্গেই সেই হোস দিয়ে বেরোত সাপ, ব্যাং ইত্যাদি অনেক কিছু!”
খন ৪১ বছর বয়সী লি সো ইয়নের বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বড় হয়ে উঠেছেন দেশের উত্তরপ্রান্তে।
তার পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্যই ছিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৯০র দশকে যখন উত্তর কোরিয়া ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে, তখন সো ইয়ন নিজে থেকেই সেনাবিাহিনীতে যোগ দিতে এগিয়ে আসেন।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান যে ভাবনাটা কাজ করেছিল তা হল বাহিনীতে দুবেলা অন্তত খাবারের চিন্তা থাকবে না। দেষের আরও অনেক মেয়ে একই কারণে সে সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথম দিকে অবশ্য দেশপ্রেমের একটা চেতনাও কাজ করেছিল, এবং ১৭ বছরের লি সো ইয়ন বাহিনীতে তার জীবন মোটামুটি উপভোগও করছিলেন।
তার জন্য যেভাবে আলাদা করে একটি হেয়ার ড্রায়ার দেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে সেটা তো তার দারুণ লেগেছিল। কিন্তু যেহেতু প্রায়ই ব্যারাকে বিদ্যুৎ থাকত না, তাই চুল শোকানোর সেই যন্ত্র কাজে লাগত না বললেই চলে।
পুরুষ ও নারী সৈনিকদের দৈনন্দিন রুটিন অবশ্য ছিল প্রায় একই ধরনের। তবে নারীদের শারীরিক প্রশিক্ষণের সময়টা ছিল পুরুষদের তুলনায় অল্প কিছুটা কম।
কিন্তু তাদের কাপড়চোপড় কাচা, পরিষ্কার করা বা রান্নাবান্নার মতো বেশ কিছু গৃহস্থালির কাজ করতে হত, যা থেকে আবার পুরুষ সৈনিকদের রেহাই ছিল।
কিন্তু কঠোর শারীরিক অনুশীলন ও পরিশ্রম, খাবারের রেশনে টান ইত্যাদি নানা কারণে লি সো ইয়ন ও তার সতীর্থ সেনাদের শরীরে প্রভাব পড়তে শুরু করে অল্প দিনের ভেতরেই।
“বাহিনীতে ঢোকার ছমাস থেকে এক বছরের মধ্যে আমাদের আর ঋতুস্রাব হত না। চরম অপুষ্টি আর ভীষণ একটা মানসিক চাপের পরিবেশে থাকতাম বলেই সেরকমটা হয়েছিল।”
“নারী সৈনিকরা অবশ্য বলত তাদের মাসিক হচ্ছে না বলে তারা খুশি। খুশি, কারণ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে তার ওপর আবার মাসিক হলে তাদের আরও শোচনীয় অবস্থার ভেতর পড়তে হত।”
লি সো ইয়ন বলছেন, ১৯৯২ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে তিনি যখন সেনাবাহিনীতে ছিলেন তখন তাকে ধর্ষিতা হতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু তার অনেক নারী কমরেডকেই সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
কাজের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোম্পানি কমান্ডার নিজের ঘরে বসে থাকতেন ও নিজের অধীনস্থ নারী সেনাদের মধ্যে কাউকে ডেকে নিয়ে সেখানে ধর্ষণ করতেন। এই জিনিস অবিরামভাবে চলত দিনের পর দিন।
উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী অবশ্য দাবি করে থাকে তারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। কোনও পুরুষ সেনা ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার সাত বছরের জেল পর্যন্ত হতে পারে।
“কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ধর্ষিতা নারী সেনারা কেউ ভয়ে সাক্ষ্য দিতেই এগিয়ে আসে না। ফলে ধর্ষণকারী পুরুষদেরও কোনও সাজা হয় না কখনওই”, বলছিলেন জুলিয়েট মরিলট নামে এক গবেষক।